করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ সেক্টর কোনটা ? আপনাকে যদি প্রশ্নটা করা হয় তবে আপনি উত্তরে হয়তো বিভিন্ন নাম বলবেন তবে সাম্প্রতি বিবিসি বাংলা ও ব্যাক এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্যটি।
এখানে বলা হয়েছে যদি সুদুরপ্রসারি চিন্তা করা হয় তবে বলতে হবে করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ সেক্টর হলো শিক্ষার সাথে যুক্ত ব্যক্তি বা ছাত্র-ছাত্রীরা।
করোনা মহামারির শুরু থেকেই বাংলাদেশেরসহ পুরো বিশ্বের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে রয়েছে। আর এই বন্ধের কারণে বেড়েছে বাল্য বিবাহ এমনই প্রতিবেদন তুলে ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে ব্র্যক বলছে করোনা মহামারিতে দারিদ্রতা যেমন বেড়েছে তেমনি সেই সাথে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। আর দারিদ্রতা যে, বাল্য বিবাহ নামক বিষয়টার জন্ম দিতে পারে সেটা এই করোনা মহামারির অবস্থা না দেখলে বোঝা যেতো না।
বিভিন্ন মাসের হিসেব নিয়ে গত জানুয়ারী ২০২১ এর প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে মার্চ থেকে স্কুল বন্ধের কারণে ৭১% এর মত বেড়েছে বাল্য বিবাহ যাদের বেশির ভাগেরই বয়স ছিল ১২ থেকে ১৫ এবং সবাই ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণির ছাত্রী। বিবিসি ফেব্রুয়ারীতে (লিংক এখানে) একটা প্রতিবেদন বের করেছে সেখানে বেশ কিছু উদাহারণ বা পরিবারের সাথে কথা বলেও দেখেছে এবং একজন মেয়েকে ছবি লুকানো অবস্থাতে দেখানো হয়েছে এবং তার কথাগুলো এমন ছিল আমি বোঝার জন্য কোর্ট করছি……
বিবিসির সাংবাদিকঃ ক্যামেরা ধরছে।
শিক্ষার্থীঃ মার্চ মাসে স্কুল বন্ধু হয়ে যাওয়ার পর আমি তখন ৭ম শ্রেণিতে পড়ি এবং পরিবারের অভাবের কারণে বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। এখন স্বামীর সংসারে এসেও দেখি অভাব। বাবার বাড়িতেও অভাব আবার স্বামীর বাড়িতেও অভাব। এই অভাব আর পিছু ছাড়লো না।
সাংবাদিকঃ পড়াশোনা কি তাহলে বন্ধ ?
শিক্ষার্থীঃ এখন আর পড়াশোনার ইচ্ছা নাই।
সাংবাদিকঃ নিজের কোন স্বপ্ন নেই পড়াশোনা করার ?
শিক্ষার্থীঃ স্বপ্ন থেকে কি হবে ? এখন তো আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
যদিও ভাষাগুলো আঞ্চলিক ছিল আর মেয়ে শ্বাশুরির কথা অনুসারে তাকে পড়াশোনা করানো হবে না আর এমনই তথ্য উঠে এসেছে।
এরকম আরও এক শিক্ষার্থীকে দেখানো হয় যেখানে বলা হয়েছে যে, মেয়েটা ৯ম শ্রেণিতে পড়তো গত মার্চ মাসে। আর তার মা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, “স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে বাসায় বসে কি করবে। তাই ভাবলাম একটাকে বিয়ে দিয়ে দেই মেয়ে একটা কমুক।”
আসলে অভিভাবকরা এমনটাই চিন্তা করে থাকেন তাদেরও তো পরিবার চালানোসহ আরও বিভিন্ন বিষয় মাথায় রাখতে হয় পরিবার চালাতে গিয়ে। আর এই চিন্তাগুলোর মধ্যে রয়েছে মেয়ে একটু বড় হলেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া। যেটা আসলে আমাদের সমাজে একটা কমন বিষয় হয়ে গেছে। ব্র্যক ছাড়াও আরও কিছু এনজিও প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদনে ৬১% বাল্যবিবাহ বেড়েছে শুধু স্কুল বন্ধ থাকার কারণে এমনটা বলেছে। আর বাল্যবিবাহ রোধ কল্পে বিভিন্ন ব্যক্তি মনে করেন যে, সরকারের উচিত ডাটাবেজ তৈরি করে আর এদেরকে আবারও পড়াশোনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা।”
আসলে কথাটা বলা যতটা সহজ বিষয়টা হয়তো এতটা সহজ হবে না। কারণ একটা মেয়ের যখন বিয়ে হয়ে যায় তার মানসিকতাসহ আরও নানা পরিবর্তন আসে। আমাদের দেশে বিয়ের পরে সন্তান হওয়া একটা কমন বিষয় যদি সেটা হয় কম শিক্ষিত পরিবার তাহলে তো কোন কথাই নেই। কারণ শিক্ষিত পরিবারগুলো বিয়ের পরে একটা ফ্যামিলি প্লানিং করলেও অশিক্ষিত পরিবারের কোন ফ্যামিলি প্লানিং থাকে না। আর এই কারণেই বেশিভাগ কম শিক্ষিত বা হাইস্কুলে পড়া মেয়েদের বিয়ের পরবর্তী বছরেই সন্তান লাভ করতে দেখা যায়। এতে করে যেমন জনসংখ্যা বাড়ে তেমনি শিশু মৃত্যু ও গর্ভকালিন মায়ের মৃত্যুর হারটাও বাড়ে।
করোনা মহারিতে বাংলাদেশে যে পরিমাণ বাল্যবিবাহ হয়েছে তার প্রভাব হয়তো এখনই বোঝা যাবে না কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ক্ষেত্রে চিন্তা করলে দেখা যাবে এটার প্রভাব অনেক ভয়াবহ। কারণ এই মেয়েগুলো পরিবার সম্পর্কে যেমন ধারণা পায় নাই আর দারিদ্রতার কারণে বিয়েতে রাজি হয়েছে অথচ করোনা মহামারিতে সকলের অবস্থায়ই এক ছিল মানে সকলেই প্রায় দারিদ্রতার মধ্যেই বসবাস করছিল।
করোনায় কেন বেড়েছে বাল্যবিবাহ ?
এমন প্রশ্নের উত্তরে বেশ কিছু কারণ বলা যেতে পারে। যেমন,
(ক) স্কুল বন্ধ থাকায় পরিবারের সাথে মতের অমিল
সাধারণত শিক্ষার্থীরা স্কুলে থাকলে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকে সন্ধ্যা ও সকালে এবং তাদের প্রতিদিনের পাঠ শেষ করার জন্য তারা পড়াশোনা করে থাকে। অথচ করোনায় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে যেহেতু কোন পড়াশোনার চাপ নেই তাই তারা অনেক বেশি অবসর সময় পেয়েছে যেটা তাদের পরিবারের সাথে অনেক বিষয়েই মতের অমিল তৈরি করেছে। এমন টিন এজ বয়সে পরিবারের সাথে সুসম্পর্কটা সেভাবে ছিল না। যদি স্কুল খোলা বা পড়াশোনা আপডেট থাকার মত কোন ব্যবস্থা থাকতো তবে তারা পারিবারিকভাবে একটা দিকে প্রেসারে থাকতো।
(খ) চাকরী হারানো ছেলেদের ছুটির কারণে বিয়ে দেওয়া
অনেক পরিবারের সন্তান যারা ছোটখাটো চাকরি করতো তাদের চাকরি চলে যাওয়া বা আপাতত চাকরি চলে যাওয়ার কারণে বাড়িতে অবস্থান করে। আর পরিবার এটাকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্রি দেখা শুরু করে এবং অনেক সময় গ্রামের মাধ্যমিকে পড়া মেয়েগুলোকেই পাত্রি হিসেবে বেশি পছন্দ হয় সেই সকল পরিবারের। যদিও সকল বয়সীদের বিয়েই বেড়েছে তবে আমি এখানে বাল্যবিবাহের কারণ বলার কারণে বাকিগুলো সম্পর্কে তেমন কোন মন্তব্য করছি না। করোনায় আমেরিকার মত দেশেই ১ কোটি ৬০ লক্ষ লোক চাকরি হারিয়েছে যেখানে আমাদের হিসেবটা জানা নেই অনুমান করলেই বোঝা যায়।
(গ) দারিদ্রতার কারণে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া
অনেক পরিবারই করোনা মহামারিতে দরিদ্র হয়েছে আর তারা তাদের পরবর্তী সময়ে মেয়েদের পড়াশোনা করাবে এমন চিন্তা থেকে বের হয়ে আসার জন্যও বিয়ে দিয়ে খরচ কমানোর চিন্তা করেছে। যদিও আমাদের দেশে এটা একটা কমন ও অনেক সাধারণ একটা বিষয়। মেয়েরা একটু বড় হলেই আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের বিয়ের জন্য প্রস্তাব আসে আর করোনায় এটা বেড়েছে। করোনার কারণে সবাই বাসায় থাকার কারণে এসব কাজ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে গ্রামের অভিভাবকদের কাছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কোন সঠিক ও বাস্তব সম্মত নির্দেশনা না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে যায়। আর আমাদের দেশের সরকারি বিদ্যালয়গুলোর চাইতে বেসরকারি বিধ্যালয় ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীর সংখ্যাটাও অনেকটা বেশি হওয়ার কারণে স্কুল বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীরা অনেকটা বেশি দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে। বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন না থাকার কারণে তারা অনেকেই জীবন চলার জন্য বিকল্প কিছু পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে দৈনিক আমাদের সময়ের এক প্রতিবেদনে ১৫০০ স্কুল এর একটা লিস্ট দেখানো হয়েছিল করোনা মহামারির সময়টাতে যদিও এর সঠিক সংখ্যাটা জানা নেই কারো কাছে।
(ঘ) ইভটিজিং বা দরিদ্র পরিবারের ভয়
অনেক সময় দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা মেয়েরা একটু বড় হলে নিরাপদ পরিবেশের জন্যও বিয়ে দেওয়ার প্রতি আগ্রহী হয়। কারণ আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদেরকে এখনও ছোট চোখেই দেখা হয়। যদিও দেশের প্রচলিত আইনে নারী-পুরুষ সমান অধিকারের কথা বলা হয় তবে বাস্তবে এটার পরিমাণটা অনেকটাই কম। আর এই কারণে বিয়ে বা নিজের জীবনের কোন বিষয়েই মেয়েদের মতামতের কোন মূল্যায়ন থাকে না। অনেক সময় দরিদ্র পরিবাররা তাদের মেয়ের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই দ্রুত বিয়ে দেওয়ার দিকে অগ্রসর হয়। কারণ কোন অঘটন বা ইভটিজিং এর শিকার হলে তাদের তা মোকাবিলা করার মত সমর্থ নেই।
(ঙ) শিক্ষা থেকে দূরে ও শিক্ষকরা নিরুপায়
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কোন সঠিক ও বাস্তব সম্মত নির্দেশনা না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে যায়। আর আমাদের দেশের সরকারি বিদ্যালয়গুলোর চাইতে বেসরকারি বিধ্যালয় ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীর সংখ্যাটাও অনেকটা বেশি হওয়ার কারণে স্কুল বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীরা অনেকটা বেশি দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে। বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন না থাকার কারণে তারা অনেকেই জীবন চলার জন্য বিকল্প কিছু পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে দৈনিক আমাদের সময়ের এক প্রতিবেদনে ১৫০০ স্কুল এর একটা লিস্ট দেখানো হয়েছিল করোনা মহামারির সময়টাতে যদিও এর সঠিক সংখ্যাটা জানা নেই কারো কাছে।
বি. দ্র. তথ্যগুলো অনলানের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে সংগ্রহীত।