শতকরা ৯০% এর চাইতেও বেশি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা তাদের নিজেদের শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারে না। যদিও বর্তমান দৃশ্যটা সামান্য পার্থক্য দেখা যায় তারপরেও শতকরাটা সঠিকই হবে জরিপের। মধ্যবিত্ত মেয়েদের শিক্ষাজীবন। মধ্যবিত্ত মানেই নিজের স্বপ্নকে বিষর্জন দেওয়া আর অন্যের মতামতকে মূল্যায়ন করা।
মেয়েদের জীবনটা আজব একটা জীবন। কারণ জন্ম থেকেই আমাদের সমাজের চোখে তারা অবহেলীত ক্ষেত্র বিশেষে পার্থক্য থাকলেও ব্যতিক্রম কখনও উদাহারণ হতে পারে না। আসলে বিষয়টা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পর্কযুক্ত। কারণ মেয়েরাও তো আমাদের মতই মানুষ আর তারাও তো আমাদের মতই সবকিছু করে থাকে। যাইহোক আজকের আর্টিকেলের বিষয়টা হলো মধ্যবিত্ত মেয়েদের শিক্ষাজীবন।
আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত মেয়েদের শিক্ষাজীবন শেষ করা অনেক কঠিন। যেখানে তারা শুরু থেকেই পরিবারের চোখে বোঝার মত সেখানে নিজেদের ইচ্ছা পূরণ করাটা একটা দূর্লভ বস্তু হাতে পাওয়ার মতই ঘটনা। তবে সমাজের উচ্চবিত্তদের চাইতে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অনেক বেশি মেধাবী হয়ে থাকে যা হয়তো তাদের মেধার বিকাশ না হওয়ার কারণে বোঝা যায় না। তবে বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই দেখা যায় মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন বিভাগে বড় বড় পজিশানে কাজ করছে যার জরিপ করলে হয়তো বোঝা যাবে উচ্চবিত্তদের চাইতে মধ্যবিত্তদের শতকরা হারটা অনেকটাই বেশি। তারপরেও মধ্যবিত্তরা কোথায় যেন আটকানোর মত একটা বাধায় লিপ্ত যদিও বা ছেলেরা চেষ্টা করে হয়তো কিছুটা পার পেয়ে যায় কিন্তু মেয়েরা তা কখনই পায় না। আমি আজকের আর্টিকেলে কয়েকটা কারণ বলার চেষ্টা করবো যেগুলো কারণে মধ্যবিত্ত সমাজের মেয়েরা তারা তাদের শিক্ষাজীবনটা শেষ করতে পারে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।
আ্ত্মসম্মানবোধ থাকাটা অনেক ভালো একটা গুন। একটা মানুষের ভালো গুনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এইটা। আমাদের দেশের মধ্যবিত্তদের সম্পদ না থাকলেও ধরা হয় এদের অনেক বেশি আত্মসম্মানবোধ আছে। আর এই আত্মসম্মান বোধ থাকার কারণে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলো নিজেরা কোন কিছু করার আগে সম্মানের বিষয়টা অনেক বেশি চিন্তা করে নেয়। আসলে এটা একা উদহারণ দিলে বোঝা যাবে। যেমন, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা যদি পড়াশোনা করে তাহলে আশেপাশের লোকজন মা ও বাবাকে নানা রকমের কথা বলে। যদিও দৃশ্যটা গ্রামে অনেক বেশি দেখা যায় তারপরেও শহরেও কম দেখা যায় না এমন দৃশ্য। আর এই কথাগুলো পজেটিভ বা নেগেটিভ অনেক ধরনের মতামতই আছে যার মধ্যে অন্যতম বিষয় হলো মা ও বাবাকে মেয়ে সম্পর্কে এমন একটা ধারণা দেয় যেটা তাদের আত্মস্মান বোধে লেগে যায়।
নিয়মিতই পত্রিকাতে দেখা যায় এমন ঘটনা। বিবিসি এক প্রতিবেদনের গ্রামে ৭ম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণির মেয়েদের বিয়ে নিয়ে একটা প্রতিবেদন বের করেছিল যেখানে মেয়ের মা বলেন যে, “মেয়ে বড় হয়ে গেলে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে।” আবার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, “অভাবের কারণে মা-বাবা তাড়াতাড়ি করে বিয়ে দিয়েছে। এখন আর পড়াশোনা করে কি করবো।” এমন দৃশ্যগুলো নতুন নয় হরহামেশায় দেখা যায় আমাদের চারদিকে। আত্মসম্মানবোধ থাকাটা ভালো তবে এ ধরনের ক্ষতিকর আত্মসম্মানবোধটা সত্যিই ক্ষতিকর। কারণ হয়তো একটা মেয়ে ডাক্তার হয়ে বা শিক্ষকী হয়ে দেশের জন্য একটা সম্পদ হতে পারতো সেখানে সামান্য আত্মসম্মানবোধের কারণে তাদের সেই ইচ্ছাশক্তিটাকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। যদিও এর পেছনে সমানের দৃষ্টিভঙ্গিটাও অনেকাংশই দায়ী।
আমাদের সমাজে এখনও মেয়েদেরকে সামাজিকভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়। যার উদহারণ যদি আমি দেই তবে বলতেই হবে চাকরিতে ছেলেদের চাইতে মেয়েদের বেতন কম দেওয়া হয়। যদিও কাজের ক্ষেত্রে কোন অংশেই কম করানো হয় না তারপরেও তাদের মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে কম দেওয়া হয়। ধারণা করা হয় মেয়েরা কাজের ক্ষেত্রে এতটা অভিজ্ঞ না হওয়ার কারণেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখনও অনেক সমাজ আমাদের দেশে আছে যেখানে মেয়ে হলে তাকে একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মানতে বাধ্য করা হয়। নিয়ম তো থাকবেই তাই বলে শুধু মেয়ে বলেই থাকবে বিষয়টা সামাজিকভাবেই অবমূল্যায়নের মত। কারণ ইতিহাস থেকে দেখা যায় মেয়েরা সবচেয়ে সম্মানের পাত্রী ছিল আর আজকের দিনে আমরা তাকে বাজারের পণ্য হিসেবে রাস্তায় রাস্তায় বা দোকানের সামনে বসিয়ে রাখি।
কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় মেয়েদের অবস্থান হয় লোক দেখানো হবে এমন জায়গাতে। তার কাজই হলো মানুষকে আকর্ষন করানো। অথচ মেয়েরাও বিভিন্ন পেশায় সমানভাবে কাজ করতে পারে সেই বিষয়টা আমাদের অজানাই রয়ে গেছে। আসলে এই বিষয়টার জন্য আমরা নিজেরাই অনেকাংশ দায়ী। কারণ আমাদের সামাজিক পরিবেশটা এখনও এমন করা হয় নাই যেখানে আমরা আমাদের মেয়েদেরকে নিরাপদে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়া এবং নিরাপদে আবার ফিরে আসার নিশ্চিত করতে পারবো।
এই বিষয়টা বোঝার জন্য আমাদেরকে গ্রামের পরিবারের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ গ্রামের বেশিভাগ পরিবারেই মেয়েদেরকে সুযোগ কম দেওয়া হয়। খাবার থেকে শুরু করে ছেলে অংশটা বেশি থাকে আর মেয়েদেরটা থাকে কম এই বিষয়টার কারণে মেয়েরা আগে থেকেই হিনমন্যতায় ভোগে যেটা একটা সময়ে তাদের মনে একটা নেগেটিভ ধারণার জন্য দিয়ে বসে পরিবার সম্পর্কে। পরিবার একটা মানুষের জন্য অন্যতম একটা জায়গা যেখান থেকে সে তার নিজের জীবনের লক্ষ্য ও শিক্ষার প্রথম ধাপটা পার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে থাকে আর সেই পরিবার থেকে যখন একটা সন্তান পক্ষপাতদৃষ্টির শিকার হয় তখন তার আর যাওয়ার জায়গা থাকে না।
আমাদের দেশে ছেলেদের পারিবারিকভাবে যতটুকু সুযোগ দেওয়া হয় তা মেয়েদেরকে দেওয়া হয় না বললেই চলে। হাতে গোনা কিছু পরিবার দিলেও সেটা নির্দিষ্ট একটা সিমারেখার মধ্যে দিয়ে রাখে। আসলে অনেক সময় পরিবার তার নিজেদের সম্মানের কথা বিবেচনা করে সুযোগ দিতে চায় না কারণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ভাবে পরিবার প্রধানরা মেয়েদের সম্পর্কে একটা নেগেটিভ ধারণা আমাদের সমাজ থেকেই পেয়ে থাকে। যেমন, বেশি লেখাপড়া করিয়ে লাভ কি বিয়ে দিয়ে দিতে হবে, মেয়েরা বেশি পড়াশোনা করলে বিয়ে হবে না, বয়স বাড়লে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে এসব নানা রকম কথার কারণে অনেক সময় মেয়েদেরকে পরিবার এতটা বেশি সুযোগ দিতেও চায় না। যদিও বর্তমানে এই বিষয়টা অনেকটাই কমে গেছে তারপরেও এটা একটা বড় কারণ আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত মেয়েদের শিক্ষিত না হওয়ার পেছনে বা কম শিক্ষিত হওয়া পেছনে।
মধ্যবিত্ত মেয়েদের শিক্ষাজীবন দিন শেষে অপূর্নতায় থেকে যায়। আমি সামান্য কিছু বিষয় আলোচনা করার চেষ্টা করেছি মাত্র যদিও আলোচনাটা আরও অনেক বড় হবে কারণ প্রত্যেকটা জীবন যেমন আলাদা তেমনি প্রত্যেকটা পরিবারের চিন্তা ও চেতনাটাও আলাদা।